MMonir Trainer 2 years ago |
সাহাবীদের আর্থিক অবস্থা।
সাহাবীদের অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে অনেকের ধারণা ক্লিয়ার না। অনেকেই মনে করেন সাহাবীরা বুঝি অনেক গরীব ছিলেন।
মোটেও না।
যেসব সাহাবী 'দুনিয়াবিমুখ' ছিলেন, তারা সচেতনভাবেই দুনিয়াবিমুখ ছিলেন। এমন না যে তাদের কিছুই ছিলো না, না থাকার কারণে দুনিয়াবিমুখ।
বরং তাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তারা সম্পদের প্রতি আসক্ত ছিলেন না।
একেকজন সাহাবী বছরে কয়েক কোটি টাকা ভাতা পেতেন, গণিমতের সম্পদ পেতেন, ব্যবসা করে টাকা পেতেন।
একটা উদাহরণ দেই।
তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ ও উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহুমা দুজন ছিলেন ধনী সাহাবী, দুজনই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত।
তালহার অর্থের প্রয়োজন হয়। তিনি উসমান ইবনে আফফানের কাছ থেকে ৫০,০০০ দিরহাম ধার নেন।
পঞ্চাশ হাজার দিরহাম বর্তমান সময়ের কতো টাকা? আনুমানিক ১০ কোটি টাকা।
ধার পরিশোধের সময় আসলে তালহা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "আপনার টাকা রেডি আছে। চাইলে এখন নিতে পারেন।"
উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, "না, থাক। টাকাগুলো রেখে দিন। এগুলো আপনাকে গিফট দিলাম।"
একজন বন্ধু আরেক বন্ধুর ১০ কোটি টাকার ঋণ মাফ করে দিলে উভয় বন্ধুর কতো টাকা থাকতে পারে শুধু চিন্তা করুন। [আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৭/২২৭।]
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় অনেক গরীব ছিলেন, বেশিরভাগ সময় অনাহারে কাটাতেন, পেটে ক্ষুধা নিয়ে হাদীস মুখস্থ করতেন। এই তথ্যগুলো আমরা সবাই জানি।
কিন্তু, আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু শেষ জীবনে কোটিপতি হন, এই তথ্যটি আমরা কয়জন জানি?
উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে আবু হুরাইরাকে বাহরাইনের গভর্নর হিশেবে নিয়োগ করা হয়। গভর্নর থাকাবস্থায় তিনি সেখানে ব্যবসা করেন, তাঁর জমিতে ফসল ফলে, তাঁর আস্তাবলের ঘোড়ার বাচ্চা হয়। সেগুলো বিক্রি করে তিনি মদীনায় ফিরেন।
তাঁর কাছে তখন ১০,০০০ দিরহাম। তখনকার সময়ের দশ হাজার দিরহাম আমাদের সময়ে (PPM অনুযায়ী) প্রায় দেড় কোটি টাকা!
যে সাহাবী কিছুদিন আগে নিঃস্ব ছিলেন, হঠাৎ করে তিনি কোটিপতি হয়ে যান। তাঁর কাছে এতো টাকা দেখে খলিফা অবাক হন। এমনকি তিনি 'সন্দেহ' করেন আবু হুরাইরা এতো টাকা কোথায় পেলেন।
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু খলিফার কাছে জবাবদিহি করেন। তারপরও উমর সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি বাহরাইনে কয়েক সদস্যের তদন্ত কমিটি পাঠালেন। তদন্ত কমিটি এসে রিপোর্ট দিলো, আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু সত্য বলছেন। তিনি ব্যবসা ও ফসল ফলনের মাধ্যমে এতো টাকা উপার্জন করেন। [আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/২২২-২২৩]
বেশিরভাগ সাহাবীদের অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। কেউ কেউ মনে করেন, সাহাবীরা বুঝি গরীব ছিলেন। হ্যাঁ, সাহাবীরা একটা সময় পর্যন্ত গরীব ছিলেন ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীতে তাঁদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়। বিশেষ করে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য বিজয়ের পর। তখন অনেক সাহাবী কোটিপতি হন। তবে, বেশিরভাগই টাকা সঞ্চয় করেননি, তারা দান করে যান। কেউ কেউ এক বসায় কোটি কোটি টাকাও পর্যন্ত দান করেন।
খাব্বাব ইবনুল আরাত রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন একজন কামার। তিনি তরবারি বানাতেন। মক্কায় এসেছিলেন দাস হয়ে। উম্মু আনমার নামের এক মহিলার দাস তিনি। মক্কার সমাজের নিম্নশ্রেণীর একজন হিশেবে ইসলাম গ্রহণের ফলে তাঁর ওপর কীরকম অমানবিক নির্যাতন করা হয় সেটা আমরা অনেকেই জানি।
তাঁকে রোদের মধ্যে শুইয়ে পিঠে গরম পাথর দেয়া হতো। ফলে তাঁর পিঠ ঝলসে মাংস পোড়ার গন্ধ বের হতো। কাফিররা সেগুলো দেখে উচ্ছ্বসিত হতো!
তাঁর অর্থনৈতিক জীবনেও বিপর্যয় নামে। মানুষ তাঁকে দিয়ে তরবারি বানাতো, কিন্তু তিনি টাকা চাইলে টাকা দিতো না। সেইসব কাফিররা বলতো, “তুমি না আখিরাতে বিশ্বাস করো? মৃত্যুর পর বিচার হবে এমন বিশ্বাস করো? আমরা তোমাকে আখিরাতে টাকা দিয়ে দেবো!”
নিজের দুঃখের কথা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতেন। আল্লাহ এই প্রসঙ্গে কুরআনের একটি আয়াত নাযিল করেন।
খাব্বাব ইবনুল আরাত রাদিয়াল্লাহু আনহু সেই কঠিন সময় ধৈর্যধারণ করেন। বদর, উহুদ, খন্দক এসব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইসলামের দূর্বল অবস্থা থেকে শক্তিশালী অবস্থা দুটোই প্রত্যক্ষ করেন। সাহাবীরা অর্থের অভাবে, খাদ্যের অভাবে খেতে পারেনি এই সময়গুলোর তিনি নিজে যেমন ছিলেন একজন সাক্ষী, তেমনি সাহাবীদের সামনে অফুরন্ত ধনভাণ্ডার যখন আসে সেই সময়গুলোও তিনি দেখতে পান।
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে যিনি ছিলেন একজন দাস, যার কাছ থেকে বাকিতে কাজ আদায় করে কাফিররা টাকা পরিশোধ করতো না, যিনি ছিলেন প্রায় নিঃস্ব, তাঁর জীবনের শেষদিকে তিনি হন কোটিপতি!
প্রথমদিকের ইসলাম গ্রহণকারী হিশেবে তিনি অনেক ভাতা পেতেন। বার্ষিক ভাতা ছিলো প্রায় কোটি টাকা। তাছাড়া গণিমতের সম্পদ পেতেন। এসব মিলিয়ে তাঁর কাছে জমা হয় প্রায় ৮০,০০০ দিরহাম। সাহাবীদের সময় আশি হাজার দিরহাম দিয়ে যা কেনা যেতো, আমাদের সময় সেই অর্থ প্রায় ১৩ কোটি টাকা।
খাব্বাব ইবনুল আরাত সেই অর্থ নিজের জন্য জমা রাখেননি। তিনি একটি জায়গায় তাঁর ১৩ কোটি টাকা রাখেন। জায়গাটি সবাই চিনতো। তিনি ঘোষণা দেন-
“যার যখন প্রয়োজন হবে, সে যেন তার প্রয়োজনমতো এখান থেকে অর্থ নেয়। এই অর্থ কখনো ফিরত দেয়া লাগবে না। এগুলো আপনাদেরই।”
যার খাবার কেনার টাকা থাকতো না, সে খাব্বাব ইবনুল আরাত রাদিয়াল্লাহু আনহুর সেই উন্মুক্ত জায়গা থেকে টাকা নিতো, যার ঋণ পরিশোধের প্রয়োজন হতো, সে খাব্বাব ইবনুল আরাতের সেই জায়গা থেকে ইচ্ছেমতো টাকা নিতে পারতো।
এ যেন উন্মুক্ত ব্যাংক! যেখান থেকে লোন নিতে দরখাস্ত করতে হয় না, জমি-জমা বন্ধক রাখতে হয় না, সুদ দিতে হয় না; উপরন্তু, সেই ঋণ পরিশোধই করতে হয় না!
যে সাহাবী একসময় নিঃস্ব ছিলেন, তিনি বাকি মানুষের জন্য এমন একটি ব্যবস্থা করে যান, যা থেকে সমাজের গরীব, নিঃস্ব, অভাবীরা উপকৃত হতে পারে।
Alert message goes here